শিরোনামঃ
পিআরের দাবিতে আন্দোলনকারীরা নির্বাচন বিলম্বের চেষ্টায় নেমেছে: মির্জা ফখরুল পাল্টা হামলায় ৫৮ পাক সেনা হত্যার দাবি আফগানিস্তানের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব এহসানুল হক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে লাইভ চলাকালে ফেসবুক পেজে সাইবার হামলা: চিফ প্রসিকিউটর শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু ইতালির উদ্দেশে দেশ ছাড়লেন প্রধান উপদেষ্টা একা গিয়ে কী করবো, সেফ এক্সিট নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অপরাধের সুষ্ঠু ও নির্মোহ বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: বিএনপির বিবৃতি আর কোনো সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরিকল্পনা নেই : প্রেস সচিব পরোয়ানা জারি হওয়া ১৫ সেনা কর্মকর্তা হেফাজতে: সেনাবাহিনী
সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১৬ পূর্বাহ্ন

উসকানি ছড়িয়ে দিচ্ছেন হুমকি-ধমকি; শেখ হাসিনা এখন কোথায়?

বিশেষ প্রতিবেদক
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫
ছাত্র-জনতার অভূত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এখন কোথায় আছেন তা নিয়ে দেশের মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশ ভারতে আছেন এটা নিশ্চিত হলেও ভারতের কোথায় আছেন সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কোনো তথ্য জানা যাচ্ছে না।

গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। ওই দিন দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে পতন হয় টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগেরও। জনরোষের ভয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন ৷ এখনো সেদেশেই তিনি অবস্থান করছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে৷ শেখ হাসিনা ভারতে আছেন এটা প্রায় নিশ্চিত। কারণ শেখ হাসিনা ভারতে আছেন- এটা ভারত সরকার কখনো অস্বীকার করেনি। আবার ভারত থেকে তিনি অন্য কোনো দেশে গিয়েছেন এখন পর্যন্ত এ রকম কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি।

ভারতীয়সহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৭ অক্টোবর দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, ‘আপনারা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভারতে অবস্থান নিয়ে জানেন…তাকে এখানে খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে চলে আসতে হয়েছিল প্রধানত সুরক্ষার কারণে। তিনি এখনো সেভাবেই আছেন। ’

এর আগে শেখ হাসিনার সংযুক্ত আরব আমিরাত বা মধ্যপ্রাচ্যের বা ইউরোপের কোনো কোন দেশে চলে যাওয়ার বিভিন্ন গুঞ্জন বিভিন্ন সময় ওঠে।

ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের পার্লামেন্টে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ভারতের রাজ্যসভার সদস্য ডা. জন বৃত্তাস ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিংয়ের কাছে জানতে চান, বাংলাদেশ শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছে কি না। যদি চেয়ে থাকে, তাহলে কী কারণে তাকে ফেরত চেয়েছে এবং ভারত সরকারের এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া কী? জবাবে কীর্তি বলেন, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে বাংলাদেশের অনুরোধের জবাব দেয়নি ভারত। রণধীর জয়সোয়াল ও কীর্তি বর্ধন সিংয়ের এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে এটুকু নিশ্চিত শেখ হাসিনা এখনো ভারতেই।

তবে তিনি ভারতের কোথায় আছেন সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেন না ৷ তার অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন সময় ভরতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে একাধিক স্থানের নাম শোনা গেলেও কোনোটাই সুনির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করা হয়নি ৷ এ বিষয়ে ভারত সরকার অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেছে ৷

অনেকের মতে, উত্তরপ্রদেশে আছেন হাসিনা, আবার অনেকে বলছেন দিল্লিতে। কেউ কেউ বলছেন, ভারত সরকারের রুটিন অনুযায়ী মাস অন্তর ভারতের মধ্যে একাধিক স্থান পরিবর্তন করেছেন হাসিনা। আবার অনেকেই বলছেন, তাকে সম্প্রতি রাজস্থানে রাখা হয়েছে।

কারও কারও মতে, তিনি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থান করছেন। কারণ একাধিক মাধ্যম বলছে, আওয়ামী লীগের পলাতক অনেক মন্ত্রী-নেতা কলকাতার সল্টলেক এবং নিউ টাউন অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন। ফলে তিনি ওই দুই অঞ্চলের মধ্যে অস্থায়ী অবস্থান করছেন। মনে করা হয়, দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও নানা ছক কষতে কলকাতায় একাধিক গোপন বৈঠক করেছেন হাসিনা। তবে এ নিয়ে নিশ্চিত কেউ বলতে পারছে না।

গত বছর ৫ আগস্ট পদত্যাগের পর শেখ হাসিনা বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজে করে বাংলাদেশ থেকে দিল্লির উপকণ্ঠে উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের কাছে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে পৌঁছান। সেখানে কিছুদিন ছিলেন। পরে তাকে দিল্লি নিয়ে আসার কথা শোনা যায়।

গত বছরের ২৪ অক্টোব ভারতের গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিলো, শেখ হাসিনা দিল্লিতে আছেন। তিনি নয়াদিল্লির লোধি গার্ডেনের লুটেনস বাংলো জোনে একটি সুরক্ষিত বাড়িতে রয়েছেন। ভারত সরকারই তার থাকার জন্য বাড়িটির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শেখ হাসিনার মর্যাদা অনুসারে তাকে থাকার জন্য বেশ বড়সড় বাংলো দেওয়া হয়েছে। সাধারণত এ ধরনের বাংলো ভারতের মন্ত্রী, পার্লামেন্ট সদস্য ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে শেখ হাসিনার গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার স্বার্থে ওই বাংলোর ঠিকানা বা সড়ক নম্বর প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়নি বলে দ্য প্রিন্ট প্রতিবেদনে জানিয়েছিলো।

শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কে এসব তথ্য বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়ার কথা উল্লেখ করে দ্য প্রিন্টের প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, শেখ হাসিনার জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সাদা পোশাকে ২৪ ঘণ্টা তার চারপাশে নিরাপত্তারক্ষীরা থাকেন। বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে তিনি এই পর্যায়ের নিরাপত্তা পাচ্ছেন। নিরাপত্তার খাতিরে যথার্থ প্রটোকল সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা মাঝে মধ্যে লোধি গার্ডেনে হাঁটতে বের হন বলেও জানানো হয়।

কয়েকটি সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে পৌঁছানোর পর সঙ্গে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা দেখা করেন। এরপর দুদিনের মধ্যে তিনি বিমানঘাঁটিটি ছেড়ে যান।

দ্বিতীয় আরেকটি সূত্র জানায়, ওই বিমানঘাঁটিতে তিনি লম্বা সময় থাকতে পারতেন না। কারণ, সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। তাই কয়েক দিনের মধ্যে তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং দিল্লির নিরাপদ ও সুরক্ষিত লুটেনস এলাকায় তার জন্য একটি বাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। এই এলাকায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। এখানে অনেক সাবেক ও বর্তমান পার্লামেন্ট সদস্যের বাড়ি রয়েছে।

শেখ হাসিনা বাড়ির বাইরে চলাফেরা করেন কি না, জানতে চাইলে সূত্র জানায়, ‘কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে মূল নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দলকে জানানো হয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ’

দ্য প্রিন্টের দেওয়া এই তথ্যের পর শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কে আর নতুন কোনো তথ্য জানা যায়নি। তবে ভারতে যাওয়ার পর কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে ফোনে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কথা বলছেন ও যোগাযোগ রাখছেন ৷ এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ফোনকলের অডিও রেকর্ড প্রকাশ ও ভাইরাল হয়েছে ৷

যদিও তিনি কেন ভিডিওতে দেখা দিচ্ছেন না বা প্রকাশ্যে আসছেন না, তা নিয়েও নানা আলোচনা-কৌতূহল আছে। দলটির নেতাদের তথ্য মতে, ভিডিওগ্রাফি অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থান স্পষ্ট করে ফেলতে পারে। যে কারণেই হাসিনার কঠোর নির্দেশ, কখনোই ভিডিওগ্রাফি করা যাবে না।

শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়সহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী দেশ ছেড়ে ভারতে অবস্থান করছেন। তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের অনেকেই দেশের বাইরে। নিকটাত্মীয় বা দলের শীর্ষ পর্যায়ের কোন নেতা তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন কি না আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো সে ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারছে না।

তবে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় গত ৬ জুন দিল্লিতে মায়ের সঙ্গে প্রথম দেখা করেন এবং একসঙ্গে ঈদ করেছেন বলে জানা গেছে। তবে কোথায় তাদের দেখা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। এও জানা যাচ্ছে, চলতি বছরের অক্টোবর অথবা নভেম্বরের দিকে জয় কলকাতায় আসতে পারেন। সেখানে পলাতক আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করতে পারেন।

ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সির সূত্রগুলো বলছে, বিমানবন্দর থেকে যথাযথ নিরাপত্তা দিয়েই তাকে পৌঁছিয়ে দেওয়া হয় শেখ হাসিনা যে গোপন ঠিকানায় আছেন সেখানে। ওই ঠিকানায় শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানাও রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে আওয়ামী লীগের কয়েকটি সূত্র।

শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও কর্মসূত্রে দিল্লিতে থাকেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচওর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন। তবে ডব্লিউএইচও এর দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক কার্যালয়ের (এসইএআরও) পরিচালক সায়মা ওয়াজেদকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠিয়েছে। গত ১১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে এই ছুটি।

এর চার মাস আগে দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে তাঁ বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুটি মামলা করে। দিল্লিতে অবস্থানরত সায়মা ওয়াজেদ পুতুল তার মা শেখ হাসিনার সঙ্গে গত এক বছরে দেখা করতে পেরেছেন কিনা সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।

নেই অনুশোচনা, প্রতিশোধের উসকানি ছড়িয়ে দিচ্ছেন হুমকি-ধমকি: 

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তীব্র জনরোষ থেকে বাঁচতে তিনি পালিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। স্বাধীনতার পর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা চালালেও পলাতক হাসিনা বা তার দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ বিষয়ে নেই কোনো অনুশোচনা-অনুতাপ। বরং বিশ্ব ইতিহাসের অভূতপূর্ভ এই অভ্যুত্থানকে ‘চক্রান্ত’ আখ্যা দিয়ে তারা দিয়ে যাচ্ছেন হুমকি-ধমকি। তৈরি করে চলেছেন প্রতিশোধপরায়ণতার বয়ান।

 

ভারতে আশ্রিত হাসিনার নামে বেশ কিছু অডিও এবং ফোনালাপ অনলাইনে ছড়িয়েছে। এর মধ্যে তার দল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেও দেখা গেছে অডিও এবং ফোনালাপ। যদিও এর কোনোটিই বাংলানিউজ যাচাই করতে পারেনি।

১২ আগস্ট শেখ হাসিনার কথিত একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। তিন মিনিটের ওই আলাপের অপর প্রান্তে ছিলেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর কবির।
ফোনালাপে ওই নারী কণ্ঠকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা শৃঙ্খলা মেনে দলীয় কার্যক্রম চালাবেন। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসকে যথাযথভাবে পালন করবেন। ’

জবাবে মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আপা আপনি ঘাবড়াবেন না, মনোবল হারাবেন না। আপনি ঘাবড়ালে আমরা দুর্বল হয়ে যাই। আমরা শক্ত আছি। ’

তখন অন্য প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘আমি ঘাবড়াব কেন? আমি ভয় পাইনি। আমাদের কর্মীদের মেরেছে। বোরকা পরে মেরেছে। এ দেশটা রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে। আপনারা যেভাবে আছেন, থাকেন। ’

পরে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কলরেকর্ডের অডিও ভাইরাল হয়। তখন বলা হচ্ছিল শেখ হাসিনা ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তানভীর কায়সারের মধ্যে এই আলাপচারিতা হয়। সেখানে শেখ হাসিনার মতো কণ্ঠে যাকে কথা বলতে শোনা যাচ্ছিল, তিনি বলেন এখনও পদত্যাগ করেননি।

তার কথায়, ‘আমি তো পদত্যাগ করি নাই। আমাদের কনস্টিটিউশনের আর্টিকেল ৫৭ অনুযায়ী যেভাবে পদত্যাগ করতে হয়, আমার কিন্তু সেভাবে পদত্যাগ করা হয়নি। ’

তাকে আরও বলতে শোনা যায়, গণভবন থেকে সরে যেতে বাধ্য হলেও রাষ্ট্রপতির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেননি। ফলে নিজেকে তখনো বাংলাদেশের ‘কনস্টিটিউশনাল ইলেকটেড প্রাইম মিনিস্টার’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

অডিওতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার ও রাজনৈতিক চক্রান্তের অভিযোগও তোলেন তিনি। দাবি করেন, ৬ আগস্ট তার বিরুদ্ধে রায়ের আগেই ‘পরিস্থিতি সৃষ্টি করে’ ৫ আগস্ট লং মার্চ সংগঠিত করা হয়। এতে প্রাণহানি ঘটে, যা তাকে সরে যেতে বাধ্য করে।

তাকে বলতে শোনা যায়, ‘যে কটা মার্ডার হইছে, পুলিশের গুলিতে হয়নি। মুভমেন্টের ভেতরে কিলিং এজেন্ট ছিল। বোরকা পরে কেউ কেউ ইন্ডাস্ট্রিতে আগুন দিয়েছে। আমি লাশের স্তূপ দেখতে চাইনি। আমি থাকতে চাইনি। ’

অন্যদিকে, তানভীর কায়সারকে অডিওতে বলতে শোনা যায়, ‘আপা, আপনি ফিরে আসবেন ইনশাআল্লাহ, আর বেশি দিন নাই। ’ তিনি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বিষয়টি জানানো হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন।

সবশেষে, ওই নারী কণ্ঠ দাবি করেন, তার ‘পদত্যাগপত্রের’ কোনো কপি কেউ দেখাতে পারেনি এবং গণভবনে যা ছিল, তা লুটপাট ও অগ্নিকাণ্ডে হারিয়ে গেছে। একই কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, তিনি দেশের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছেন, যাতে চট করে দেশে ঢুকে পড়তে পারেন।

অক্টোবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় শেখ হাসিনার কণ্ঠসদৃশ আরেকটি ফোনালাপ। ওই কথোপকথন হয় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শাকিল আলম বুলবুলের সঙ্গে।

ফোনালাপে ওই নারী কণ্ঠে শোনা যায়, ‘ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তোমাদের বাড়িঘরে যারা আগুন লাগিয়েছে, তাদের বাড়িঘর নেই? সব কথা কি বলে দিতে হয়?’

অন্য প্রান্ত থেকে শোনা যায় শাকিল আলম বুলবুলের কণ্ঠস্বর। তিনি বলেন, ‘জ্বি নেত্রী, আপনার কথায় আমরা ভরসা রাখছি। ’

জবাবে ওই নারী কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, ‘যারা বেশি বাড়াবাড়ি করছে, তারা বেশি ভালো থাকবে না। কাউকে পালাতেও দেওয়া হবে না। যারা নাফরমানি করেছে, তাদের অস্ত্রও থাকবে না। ’

শাকিল অনুরোধ করেন, নেত্রী যেন মাথা ঠান্ডা রেখে কৌশলে এগিয়ে যান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুই মাস অপেক্ষা করো। কিছু বলো না। ওরা ফেল করবে। ’

একপর্যায়ে শাকিল বলেন, ‘মানুষ ভয়েই চুপ হয়ে আছে। ’ জবাবে ওই নারী কণ্ঠে ভেসে আসে, ‘এখন ভয় পাওয়ার সময় নয়, ভয় দেখানোর সময়। ’

নভেম্বরে আরও একটি কথোপকথন ছড়িয়ে পড়ে এতে শেখ হাসিনার কণ্ঠের মতো একজন দলীয় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেন। ফোনালাপের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের খুনি বলে আখ্যায়িত করা হয়।

ফোনালাপে বলতে শোনা যায়, ‘এই অবৈধ সরকারের অত্যাচারে সারাদেশের মানুষ জর্জরিত। কৃষক-শ্রমিকরা বেকার হয়ে গেছে। শ্রমিক আন্দোলন করেছে, সাথে সাথে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। চাকরির বয়স নিয়ে আন্দোলন করতে যমুনার সামনে গেল, সাথে সাথে গুলি করলো। সেখানে একজন মারা গেলো এবং পিটিয়ে উঠিয়ে দিলো। ’

এছাড়া আরেকটি কথিত ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে ২২৭ জনকে হত্যার হুমকি দিতে শোনা যায়। গত ৩০ এপ্রিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়েরের পর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান,  ‘আমার বিরুদ্ধে ২২৭টি মামলা হয়েছে, তাই ২২৭ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’, এমন মন্তব্যে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া বিতর্কিত অডিও ক্লিপটি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই। এ সংক্রান্ত ফরেনসিক প্রমাণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

যদিও কয়েকটি ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেননি। ভেতর থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে আন্দোলনকারীদের।

কিন্তু সম্প্রতি বিবিসি ও আল জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিক্ষোভ দমনে শেখ হাসিনা সরাসরি লেথাল উইপন (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা দেওয়ার ফোনালাপ তারা যাচাইও করেছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই অভ্যুত্থানকালে প্রায় ১৪শ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। চোখ, পা ও হাত হারান শত শত আন্দোলনকারী। রাষ্ট্রীয় এই হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নের সমন্বয়কের ভূমিকা ছিলেন খোদ শেখ হাসিনা।

গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে বলেছিল, মাসে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনার ‘ফাঁস’ হওয়া অডিওগুলো সত্য বলে একাধিক ভারতীয় সূত্র ধারণা করছে। যদিও সরকারিভাবে ভারত কোনও মন্তব্য করেনি, তবে দিল্লির সূত্রের মতে এগুলো সম্ভবত শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরই।

দিল্লির নর্থ ব্লকের একজন কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনার পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগে কোনো বাধা নেই, কেউ সেই আলাপ রেকর্ড করে ছড়িয়ে দিলে তা নিয়ে সরকারের কিছু করার নেই।

কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, দিল্লি ইচ্ছাকৃতভাবেই এসব কথোপকথন ফাঁস করতে দিচ্ছে যাতে তা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে মনোবল ধরে রাখা যায়। বিভিন্ন সময়ে হাসিনার বিবৃতিও প্রকাশিৎ হয়েছে।

ভারতে বসে শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টি ঢাকা ভারতীয় হাইকমিশনার এবং দেশটির সরকারকে একাধিকবার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে চলে যাওয়ার পর সেখানকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক বিবৃতি ও বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটি বাংলাদেশ ভালোভাবে দেখছে না।

ভারতের মাটিতে বসে শেখ হাসিনা যেন নিজের বয়ানে কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিবৃতি না দেন, সে জন্যও তাকে ভারতের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় বলে বিবিসি জানতে পারে।

গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে জুনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগে চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।


এ জাতীয় আরো খবর...