‘বাজারে সবজির দরদামের সুযোগ দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। তারা যে দাম বলছেন সেই দামেই কিনতে হচ্ছে। কোনো উপায় নেই, এমন মন্তব্য করেন চাকরীজীবি এক ভোক্তা।
আরেক ক্রেতা বলেন,সব কিছুর দাম চড়া থাকায় প্রয়োজনের তুলনায় কম কিনতে হচ্ছে। কঠোর মনিটরিং ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।’
শুক্রবার ছুটির দিনে রাজধানীর মাছের বাজারে উত্তাপ বরাবরই বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বৈরী আবহাওয়ার অজুহাতে বেড়েই চলছে বিভিন্ন প্রজাতির দাম। ভরা বাজারেও বলা হচ্ছে, এখনও যোগান সংকট কাটেনি। মধ্যবিত্তের শুক্রবার (২২ আগস্ট) রাজধানীর নয়াবাজার ও কারওয়ান বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহ ব্যবধানে বেড়েছে মুরগির দাম। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়। যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। সোনালি মুরগি ৩২০-৩৪০ টাকা, সাদা কক ৩০০ টাকা, লাল কক ২৮০-৩০০ টাকা এবং দেশি মুরগি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের একাধিক মুরগি বিক্রেতা বলেন, ব্রয়লার মুরগির দাম দুই সপ্তাহ ধরে বাড়ছে। তবে সোনালি ও অন্যান্য মুরগির দাম কিছুটা ওঠানামা করছে।
ডিমের বাজারেও লেগেছে আগুন। গত মাস খানেক ধরে বাড়ছে দাম। বর্তমানে প্রতি ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়; যা গত সপ্তাহেও ছিল ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা। এছাড়া প্রতি ডজন সাদা ডিম ১৪০ টাকায় কিনতে হচ্ছে; যা গত সপ্তাহেও ছিল ১৩৫-১৪০ টাকা। আর প্রতি ডজন হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকায়।
তবে গরু ও খাসির মাংসের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়, খাসির মাংস ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ছাগলের মাংস ১ হাজার ১০০ টাকায়।
বাজারে ওঠানামা করছে সবজির দাম। গত সপ্তাহের তুলনায় হাতেগোণা কয়েকটি সবজির দাম কমলেও বেড়েছে বেশিরভাগের। বর্তমানে প্রতিকেজি গোল বেগুন ১৬০ টাকা, লম্বা বেগুন ৬০-৮০ টাকা, টমেটো ১৭০ টাকা, করলা ৭০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৬০ টাকা, কাঁকরোল ৭০-৮০ টাকা, পটল ৬০-৭০ টাকা, ধুন্দল ৪০-৫০ টাকা, কচুর মুখী ৬০ টাকা, শসা ৫০-৭০ টাকা ও পেঁপে ২০-২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া বরবটি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, গাজর ৭০ টাকা, পেঁয়াজ ৮০ টাকা, আলু ২০-২৫ টাকা, ধনেপাতা ৩০০ টাকা, চিচিঙ্গা ৮০ টাকা ও উচ্ছে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি পিস চালকুমড়া ৬০ টাকা ও প্রতি পিস লম্বা লাউয়ের জন্য গুনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা।
সবজির পাশাপাশি দাম চড়েছে সব ধরনের শাকেরও। প্রতি মুঠো লাউ শাক ৪০ থেকে ৫০ টাকা ও পুঁইশাক ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি আঁটি ডাঁটাশাক ২০-২৫ টাকা, কলমি শাক ১৫ টাকা, লালশাক ২০-৩০ টাকা ও পাটশাক ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা বলছেন, সরবরাহ কম থাকায় শাক-সবজির দাম বাড়ছে। তবে চলতি সপ্তাহে কমেছে কয়েকটির দাম। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা বলেন, কিছু কিছু সবজির দাম কমেছে। আবার কোনোটার দাম বেড়েছে, আবার স্থিতিশীল রয়েছে কোনো কোনো শাক-সবজির দাম। গ্রামে-গঞ্জে সব জায়গায় এখন পানি। ফসলের ক্ষেত ডুবে গেছে অনেক জায়গায়। এতে সরবরাহ বাড়ায় দাম চড়েছে।
আরেক সবজি বিক্রেতা বলেন, ‘সরবরাহ কম থাকায় কমছে না শাক-সবজির দাম। আর দাম চড়া হওয়ায় ক্রেতারাও পরিমাণে কম কিনছেন। এতে কমে গেছে বেচাকেনা।’
তবে বাজারে কমেছে কাঁচা মরিচের দাম। বর্তমানে প্রতিকেজি ভারতীয় কাঁচা মরিচ ১২০ টাকা ও দেশি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। গত সপ্তাহেও এর দাম ছিল ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। বিক্রেতারা বলছেন, ভারত থেকে প্রচুর কাঁচা মরিচ আমদানি হচ্ছে। এতে বাজারে সরবরাহ বাড়ায় দাম কমছে।
এদিকে নতুন করে বেড়েছে মসুর ডাল ও আটার দাম। প্রতিকেজি খোলা আটা ৪৫ থেকে ৫০ এবং প্যাকেট আটা ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি মসুর ডাল কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত; বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। আর ভারতীয় মসুরির ডাল কেজিতে বেড়েছে ৫ টাকা; বিক্রি হচ্ছে ৯৫-১০৫ টাকায়।
ভারত থেকে আমদানির প্রভাবে বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি রসুনের কেজি ৮০ থেকে ১২০ এবং আমদানি করা রসুনের কেজি ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আমদানির প্রভাব পড়েনি চালের বাজারে। বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দামেই। রাজধানীর কারওয়ানবাজারের চাল ব্যবসায়ী রাকিব বলেন, নতুন করে দাম বাড়েনি। তবে কমারও কোনো সুখবর নেই। বর্তমানে মিনিকেট চালের কেজি ৮২-৮৫ টাকা, নাজিরশাইল ৮৫-৯২ টাকা এবং মোটা চাল ৫৬-৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে, মাছের বাজারে তেমন একটা দাম না বাড়লেও বিক্রি হচ্ছে আগের চড়া দামেই। বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকায়। আর ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৬০০ টাকা, ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৮০০ টাকা এবং দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকায়।
এছাড়া প্রতিকেজি বোয়াল ৭৫০-৯০০ টাকা, কোরাল ৮৫০ টাকা, আইড় ৭০০-৮০০ টাকা, চাষের রুই ৩৮০-৪৫০ টাকায়, কাতল ৪৫০ টাকা, তেলাপিয়া ১৮০-২২০, পাঙাশ ১৮০-২৩০, কৈ ২০০-২২০ এবং পাবদা ও শিং বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকায়। আর চাষের ট্যাংরা প্রতি কেজি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, কাঁচকি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা ও মলা ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারের এই অস্থির প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন জানান, ‘অনেক ব্যবসায়ী অতি মুনাফা করছে এবং হঠাৎ করেই তারা সবাই মিলে সিন্ডিকেটে নামছে। এর ফলে অল্প সময়ে অনেক পণ্যের দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত আমদানি ও মজুত থাকা সত্ত্বেও যারা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তাই ব্যবসায়ী নামক কিছু মূল্যসন্ত্রাসীরা কিছু দিন পরপর এক-একটি পণ্য নিয়ে এমন ধরনের কারসাজি চালাচ্ছেন।’
বাজারে কেনো মনিটরিং নেই উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো তৎপর নয়। তারা নানা প্রটোকলে ব্যস্ত থাকার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মনিটরিং বলতে শুধু ভোক্তা অধিকারের বাজার তদারকি বোঝানো হয় না; বরং আমদানিকারক, পাইকারি বিক্রেতা ও উৎপাদকরা পণ্যের দাম, শুল্ক, অন্যান্য ট্যাক্স ও খরচ এবং বিক্রির হিসাব কীভাবে করেছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু সরকারের কেউ এগুলো দেখতে চান না। বরং সবাই ব্যস্ত থাকেন কীভাবে ব্যবসায়ীদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে বাড়তি পাওনা আদায় করা যায়।’