ফেনীতে হঠাৎ আলোচনায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী। যদিও তিনি চার বছর আগে ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। কিন্তু হঠাৎ করে হাজারীকে সামনে এনে কি উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, এমন আলোচনা-সমালোচনায় ফেনী এখন টপ অব দ্যা টাউন।
এক সময়ের মুর্তিমান আতঙ্ক ও গডফাদার খ্যাত জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এ সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব স্থানীয় নেতাকর্মীরা। নিজ দলের নোতাকর্মী ও সাবেক এমপিদের স্যোসাল মিডিয়ার একাউন্ট খুঁজলেই ছবিসহ হাজারীর নাম ভাসছে গেল। কেউ আবেগ দিয়ে হাজারীর প্রত ২০০৮ সালের পর অবিচারের জন্য অনুসূচনা করেন। আবার কেউ হাজারীর রাজনীতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর স্বীকারোক্তি দিয়ে ক্ষমাও চান।
ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিম সম্প্রতি তার ফেসবুক একাউন্টে ২০০৮ পরবর্তী জয়নাল হাজারীর রাজনীতিতে বাধার কারন স্বীকার করে এ জন্য ক্ষা প্রার্থনা করেন। উল্লেখ করে, হাজারীর সময়ের চেয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর সময়ে এক হাজার গুন বেশি ক্ষতচিহৃ ফুটে উঠে। ফেনীর রানীতি ধংসের জন্য নিজাম হাজারী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দোষারোপ করেন সাবেক এ আমলা নাসিম। তার এ পোস্টে কমেন্ট পড়েছে প্রায় আড়াই হাজার। শেয়ার হয়েছে ৬শ’র বেশি। এরমধ্যে বেশির ভাগ মতামতই হাজারীর পক্ষে।
নাসিমের পোস্টে বেশিরভাগ মন্তব্য ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর বিরোদ্ধ। এসব মন্তব্যে সবাই ফেনীর নষ্ট রাজনীতির জন্য তাকেই দায়ি করেন। আবার অনেকে আলাউদ্দিন নাসিমকে লক্ষ্য করে বলেন, তিনিই ফেনীর রাজনীতি ও আওয়ামী লীগের করুণ দশার জন্য দায়ি, যা নিজেই স্বীকার করেছেন।
জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জিলা মিমি তার পোস্টে লিখেছেন, চলে যাওয়া মানে প্রস্তান নয়, হাজারী ভাই আপনি মরেও অমর।
জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট এ এস এম শহিদ উল্লাহ পোস্টে আলাউদ্দিন নাসিমকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ২০ বছরের অপকর্মের সমাপ্ত উলিব্ধ কখন প্রকাশ করবেন।
সোনাগাজী পৌরসভার পলাতক মেয়র এডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকন লিখেছেন নিজাম হাজারীর নেতৃত্বেই ফেনী আওয়ামী লীগ।
অনেকের মতে জয়নাল হাজারীর নাম সামনে এনে পতিত নেতাদের সরব করে কর্মী-সমর্থকদের মাঠে নামানোর পন্দা আঁকছেন দেশের বাইরে থাকা সুবিধাভোগীরা।
হঠাৎ জয়নাল হাজারী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে আলোচনাকে ভালভাবে দেখছেনা স্থানীয় প্রশাসন। এমনিতেই শেখ হাসিনার পতনের পর কয়েকবার গুপ্ত মিছিল করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। সম্প্রতি হোয়াটশাপে নিজস্ব গ্রুপে ফেনীতে নাশকতা নিয়ে কথোপতন হয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের।
অন্যদিকে, ফেনী পৌর বিএনপির সদস্য সচিব এডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন ভূঁঞা বলেন, হাজারীকে সামনে এনে মূলত আওয়ামী লীগ নেতারা কর্মীদের দিয়ে নাশকতা করাতে চায়।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, যাদের অপকর্মের জন্য শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী পলাতক, তাদের কথায় আর দল চলবে না।
জয়নাল হাজারী ১৯৪৫ সালের ২৪ আগস্ট ফেনী শহরের মাষ্টারপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম গনি হাজারী। ফেনী সরকারি কলেজের ছাত্র থাকাকালীন, ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
জয়নাল হাজারী ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রায় বিশ বছরের বেশি সময় ধরে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে ফেনী-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৬–২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে জয়নাল হাজারী ফেনীতে ‘ত্রাসের রাজত্ব’ কায়েম করেছিলেন। সে সময় ফেনীতে তাঁর নেতৃত্বে ‘স্টিয়ারিং কমিটি’, ‘ক্লাস কমিটি’ গঠনসহ নানা ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনায় ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের পাশাপাশি নিজ দলের বিরোধীদের ওপরও নির্যাতন চালান জয়নাল হাজারী। সে সময় সাংবাদিকেরাও তাঁর নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি।তিনি “ফেনীর গডফাদার” নামে পরিচিত ছিলেন। ক্ষমতায় থাকার সময় তার বিরুদ্ধে নির্যাতন, চাঁদাবাজি ও হত্যার অভিযোগ ছিল।
সংসদ সদস্য থাকাবস্থায় ‘জয়নাল হাজারী বলছি’, ‘বিজুর বিচার চাই’, ‘বাধনের বিচার চাই’’ ও বাধন আছে, বিজু কোথায়’? বই লিখে আলোচিত হন জয়নাল হাজারী।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট জয়নাল হাজারীর বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। তিনি তখন পালিয়ে আত্মগোপনে ভারতে চলে যান। তার অনুপস্থিতিতে পাঁচটি মামলায় তাকে মোট ৬০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৫ এপ্রিল তিনি ফেনী আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাকে কুমিল্লা কারাগারে পাঠানো হয়। একই বছরের ২৬ আগস্ট মোট ২৩টি মামলার মধ্যে ১১টিতে হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয় এবং বাকি ১২টি মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়। এরপর তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হন।
পলাতক থাকা অবস্থায় ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে, তৎকালীন দলীয় সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের উপস্থিতিতে ফেনীর সভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে এবং একই বছরে সদর উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। সাংগঠনিক বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কারণে ২ মে ২০০৫ সালে তাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
পরে আবার জয়নাল হাজারীকে দলে ফিরিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। ২০১৯ সালে তাঁকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীতে স্থান দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে ফুপাতো ভাই ও এক সময়ের সহযোগী নিজাম উদ্দিন হাজারী জয়নাল হাজারীর জায়গা দখলে নেন।
২০১২ সালে হাজারী গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেন এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার অনুমতি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। তার অসুস্থতার জন্যে চিকিৎসা ব্যয় হিসেবে ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ত্রাণ তহবিল থেকে হাজারীকে ৪০ লাখ টাকার অনুদান প্রদান করেন। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পদ পান তিনি।
হাজারী ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হবার পর, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ফেনীতে সন্ত্রাসের শিকার হয়ে প্রায় ১২০ জন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়। এর জন্যে প্রতিবারই হাজারীকে সন্দেহ করা হয়। ২০০১ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৬ আগস্ট রাতে হাজারীর বাসভবনে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। এরপরই তিনি আত্মগোপনে চলে যান। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে দল থেকে বহিষ্কৃত ঘোষণা করা হয় তাকে। চার বছর পর ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর তিনি ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্নভাবে আলোচনায় উঠে আসেন হাজারী। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে মারা যান জয়নাল হাজারী।