ইসরায়েলি দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বসতি সম্প্রসারণকে আন্তর্জাতিক আইন অবৈধ ঘোষণা করেছে। তবুও পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গোলান মালভূমিতে বসতি গড়ে তোলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকায় ১৫৮টি আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় কোম্পানির নাম এসেছে, যারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এসব অবৈধ বসতি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত। এ তালিকায় রয়েছে বিশ্বের পরিচিত ভ্রমণ প্ল্যাটফর্ম, নির্মাণ কোম্পানি, ভোক্তা পণ্যের ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে বহুজাতিক খাদ্যচেইন পর্যন্ত।
Airbnb, Booking.com, Expedia ও TripAdvisor-এর মতো জনপ্রিয় অনলাইন বুকিং প্ল্যাটফর্মে দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের বসতিগুলিতে থাকা অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল ও পর্যটনকেন্দ্রের বিজ্ঞাপন দেখা গেছে। এসব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যটকরা অবৈধ বসতিগুলোতে যাওয়া ও থাকা সহজ হয়েছে, ফলে বসতিগুলোর অর্থনীতি ও বৈধতার ভাবমূর্তি শক্তিশালী হয়েছে।
ইউরোপীয় ও ইসরায়েলি বেশ কয়েকটি কোম্পানি সরাসরি বসতি নির্মাণে যুক্ত থাকার অভিযোগে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে Heidelberg Materials AG (জার্মানি), Steconfer (পর্তুগাল), Ineco (স্পেন), Alstom (ফ্রান্স), Egis (ফ্রান্স) এবং Electra Group Ltd. (ইসরায়েল)। এরা সড়ক, রেল, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ করেছে, যা দখলকৃত ভূখণ্ডে বসতি টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।
Export Investment Company Ltd., Hadar Group, Hamat Group Ltd., Kardan N.V., এবং Mayer’s Cars and Trucks Co. Ltd. সরাসরি বসতি অঞ্চলে ব্যবসা ও বিনিয়োগ করেছে বলে জাতিসংঘের তালিকায় উল্লেখ আছে। তাদের কার্যক্রম বসতির অর্থনৈতিক টেকসই কাঠামো গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে।
ইসরায়েলের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালাচ্ছে কোকা-কোলা ও পেপসিকো। সমালোচকদের মতে, এসব কোম্পানির স্থানীয় উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসরায়েলি অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে, যা দখলনীতিকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। বিশেষত পেপসিকোর মালিকানাধীন সোডাস্ট্রিম আগে পশ্চিম তীরের একটি বসতিতে কারখানা পরিচালনা করত, যা আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পরে নেগেভে সরিয়ে নেওয়া হয়।
জাতিসংঘের তালিকায় উল্লেখিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ্বখ্যাত ফাস্টফুড ব্র্যান্ড KFC। অভিযোগ উঠেছে, ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো বসতি অঞ্চলে ব্যবসা চালিয়েছে, যা অর্থনৈতিকভাবে বসতিগুলোকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
এছাড়াও পূর্ববর্তী সময়ে সমালোচিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্যাটারপিলার (বুলডোজার দিয়ে বসতি নির্মাণ ও ঘরবাড়ি ভাঙচুরে ব্যবহারের অভিযোগ), হিউলেট-প্যাকার্ড (HP) (চেকপয়েন্ট ও নজরদারি সিস্টেমে প্রযুক্তি সরবরাহের অভিযোগ) এবং ব্রিটিশ নিরাপত্তা কোম্পানি জি৪এস (কারাগার ও নিরাপত্তা সেবা সরবরাহের অভিযোগ)।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের প্রকাশিত এই তালিকা প্রকাশের পর মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছে, এই কোম্পানিগুলো বসতি কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতার ছাপ দিচ্ছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে সচল রাখছে। এ কারণে BDS (Boycott, Divestment and Sanctions) আন্দোলন এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক বয়কটের ডাক দিয়েছে। ইতোমধ্যেই কিছু আন্তর্জাতিক তহবিল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে।
অভিযোগের মুখে অধিকাংশ কোম্পানি বলে আসছে, তারা কেবল ব্যবসায়িক ও স্থানীয় আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করছে। রাজনৈতিক ইস্যুতে কোনো অবস্থান নেয় না। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী কর্মকাণ্ডে অংশীদার হয়ে উঠছে।
এই প্রতিবেদনটি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করে কেন কিছু বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে অভিযোগ উঠেছে — বিশেষভাবে যে অভিযোগগুলো বাণিজ্যিক কার্যক্রম, সরবরাহ বা প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বসতি-চলাচলে বা নির্ধারিত সামরিক/প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। আরেকটি লক্ষ্য হলো কোম্পানিগুলো কীভাবে প্রতিক্রিয়া করেছে—সংক্ষিপ্ত উদাহরণ ও উৎসসহ।
জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা এবং সিভিল সোসাইটি অনেক বছর ধরে বিভিন্ন কোম্পানির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অভিযোগগুলোর ধরন মূলত তিনটি: (১) অর্থনৈতিকভাবে বসতি ও নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করা, (২) প্রযুক্তি/সেবার মাধ্যমে প্রশাসনিক বা নিরাপত্তা প্রক্রিয়ায় অবদান রাখা, এবং (৩) প্ল্যাটফর্ম বা পরিষেবা দিয়ে বসতিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বাভাবিক/বাণিজ্যিকভাবে উপস্থিত করা। নিচে প্রধান কোম্পানিগুলো নিয়ে টেবিল ও বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হলো।
কোম্পানি | প্রধান অভিযোগ / কীভাবে “সহায়তা” করছে বলে বলা হয় | উদাহরণ / ঘটনার ইঙ্গিত | কোম্পানির প্রতিক্রিয়া / পরিণতি |
---|---|---|---|
Coca-Cola (কোকা-কোলা) | ইসরায়েলি অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও বটলিং/লোকাল অপারেশন দিয়ে পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক শক্তি প্রদান—যা বাল্কভাবে বসতি/একের পক্ষের নীতিকে সহায়তা করে বলে সমালোচনা। | ইসরায়েলে স্থানীয় বটলার/পার্টনারের মাধ্যমে দীর্ঘকালীন উপস্থিতি; BDS আন্দোলন কোম্পানিটিকে বয়কট তালিকাভুক্ত করেছে। | কোম্পানি সাধারণত বলে যে তারা মানবাধিকার নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; সার্বিকভাবে ব্যবসা বজায় রেখেছে, কিন্তু গ্রাহক-চাপে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। |
PepsiCo / SodaStream | SodaStream-এর কারখানা পূর্বে পশ্চিম তীরে (অবৈধ বসতিসংলগ্ন এলাকা) অবস্থিত ছিল—সরাসরি বসতি-অর্থনীতিকে সাহায্য করতো। | SodaStream-এর কারখানা বসতিতে থাকার কারণে আন্তর্জাতিক চাপ এবং বয়কট শুরু হয়; পরে কোম্পানি কারখানা স্থানান্তর করে। | সোডাস্ট্রিম কারখানা সরিয়েছে; PepsiCo-র অধিগ্রহণের পরও রাজনৈতিক ও এথিক্যাল প্রশ্ন রয়ে গেছে। |
Caterpillar | সামরিক/নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত বড় বুলডোজার (D9 ইত্যাদি) বসতি সম্প্রসারণ ও বাড়ি ধ্বংসে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ—ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরাসরি অবদান। | Human Rights Watch ও অন্যান্য রিপোর্টে এমন ব্যবহার উল্লেখ রয়েছে; কিছু বিনিয়োগকারী কেটারপিলার থেকে বেরিয়ে গেছে। | Caterpillar সাধারণত বলে যে তারা সরকারি চাহিদা ও রপ্তানি নিয়ম মেনে চলে; কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি দিক থেকে চাপ গিয়েছে। |
Hewlett-Packard (HP) | আইটি/নজরদারি/ডেটা সিস্টেম সরবরাহ করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচয় যাচাই-প্রক্রিয়ায় অবদান রাখার অভিযোগ। | কয়েকটি তদন্ত রিপোর্ট HP-এর সরবরাহ ও সিস্টেমের ব্যবহার আলোচ্য করেছে; কিছু শিক্ষা/ধর্মীয় বিনিয়োগকারী ডিভেস্টমেন্ট করেছে। | HP বলেছে তারা আইনি ও কনট্রাকচুয়াল দায়িত্ব মেনে চলে; তবু কিছু প্রতিষ্ঠান নীতি-চাপে ডিভেস্টমেন্ট করেছে। |
G4S (প্রাইভেট সিকিউরিটি) | প্রাইভেট সিকিউরিটি সেবা দিয়ে সীমান্ত/নিরাপত্তা কার্যক্রমে অংশ—মানবাধিকার গ্রুপ গুলোর অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে। | চাপের পর G4S কিছু ব্যবসায়িক অংশ বিক্রি/স্থগিত করেছে; এটি অনেকেই অ্যাকটিভিস্টদের সফলতা বলে দেখেন। | কিছু অপারেশন বিক্রি বা বদল করেছে; পুরো প্রত্যাহার আংশিক ও বিতর্কিত। |
নোট: উল্লিখিত টেবিলটি সারসংক্ষেপ—প্রতিটি লাইনের পেছনে সময়ভিত্তিক রিপোর্ট, তদন্ত ও সংবাদ কভারেজ রয়েছে। বিস্তারিত টাইমলাইন ও উৎস-ডকুমেন্ট যোগ করলে প্রতিটি কোম্পানির প্রতিক্রিয়া ও আইনি/কর্পোরেট কাগজপত্র আরও স্পষ্ট হবে।
বহুজাতিক কোম্পানিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উঠেছে, তা মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
বেশিরভাগ কোম্পানি দাবি করে যে তারা স্থানীয় আইন, আন্তর্জাতিক রপ্তানি/অপারেশন নিয়ম ও কর্পোরেট নীতিমালা মেনে কাজ করে। অনেক সময় তারা বলে থাকে যে মানবাধিকার রক্ষা তাদের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার এবং তারা নিরপেক্ষ ব্যবসায়িক ভূমিকায় রয়েছে। আবার অনেকে নির্দিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ বা স্থানান্তর করে—যেমন SodaStream-এর কারখানা সরানো—তাতে BDS-ধর্মী আন্দোলনগুলোকে একধরনের বিজয় হিসেবে দেখা হয়েছে।
আন্তর্জাতিকভাবে কিছু সরকার, পেনশন ফান্ড ও ইথিকাল বিনিয়োগকারী কোম্পানি বা সেক্টর থেকে ডিভেস্টমেন্ট করেছে। মানবাধিকার গ্রুপ ও রিসার্চ আইটেমগুলো (যেমন WhoProfits, Human Rights Watch) কোম্পানিগুলোকে নজরে রেখেছে এবং জাতিসংঘ নিজেও কিছু পরিস্থিতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক তালিকা বা ডাটাবেস আপডেট করেছে — যা কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীদের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে।
কিসে ‘সহায়তা’ হয়ে থাকে—সে প্রশ্নে জবাব সরল নয়। সরাসরি অস্ত্র বা ট্যাকটিক্যাল সাপোর্ট না দিয়েও অর্থনীতি, সেবা ও প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে একধরনের সহায়তা এবং বৈধতা প্রদান করা যায়। এই কারণেই সিভিল সোসাইটি, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো কর্পোরেট আচরণ, সরবরাহ শৃঙ্খল ও স্থানীয় কার্যক্রম বিশ্লেষণ করছে এবং কোম্পানিগুলোকে দায়বদ্ধ রাখার দাবি জানিয়েছে।
সূত্র (বাছাইকৃত অনলাইন রেফারেন্স — পড়ার সুবিধার্থে):
ফিলিস্তিন প্রশ্নে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সম্পৃক্ততা এখন আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। পর্যটন, অবকাঠামো, খাদ্য, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা খাতে তাদের উপস্থিতি কেবল ব্যবসায়িক নয়, বরং রাজনৈতিক ও মানবাধিকার প্রশ্নেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই কোম্পানিগুলোর ওপরও আন্তর্জাতিক দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।