রাষ্ট্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) প্রতিষ্ঠা করেছিলো আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৩ সালে এটা প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাজ ছিলো নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতা। আওয়ামী লীগ সরকারের গড়া সেই প্রতিষ্ঠানই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আড়ি পেতেছিলো গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ফোনালাপে। শেখ হাসিনার একাধিক কল তারা গোপনে রেকর্ড করেছিলো।
শেখ হাসিনার সেসব কল রেকর্ড এনটিএমসি থেকে উদ্ধার করেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা। এসব কল রেকর্ডে উঠে এসেছে জুলাই আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেয়া শেখ হাসিনার নানা নির্দেশনা।
সাবেক মন্ত্রী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এসএম মাসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার ফোনালাপে এসব নির্দেশনার বিষয়টি উঠে এসেছে। জুলাই আন্দোলনের সময় এই তিনজনের সঙ্গে করা শেখ হাসিনার ফোনালাপগুলো গোপনে রেকর্ড করেছিলো রাষ্ট্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ এমন তথ্য প্রকাশ করেন চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এম. তাজুল ইসলাম।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চতুর্থ দিনের মত যুক্তিতর্কে অংশ নিয়ে বিচারপতি মো. গোলাম মূর্তজা মজুমদারের নের্তৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালকে এ তথ্য জানান চিফ প্রসিকিউটর।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার গুরুত্বপূর্ণ ফোনালাপগুলো উদ্ধার করা হয়েছে এনটিএমসি থেকে। এনটিএমসিতে যারা সার্ভিল্যান্সের (নজরদারি) দায়িত্বে নিয়োজিত তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যাদের কনভারসেশন হয়েছে তাদেরকে এই সার্ভিল্যান্সের আওতায় এনেছিলেন। রেকর্ড করা হয়েছিলো গোপনে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই মামলার বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এসব ফোনালাপ রেকর্ড এনটিএমসি থেকে উদ্ধার করেছে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এসব ফোনালাপ রেকর্ড হয়েছে সেহেতু এগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নাই।
তিনি ট্রাইব্যুনালকে আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনটিএমসি থেকে যেহেতু এসব রেকর্ড উদ্ধার করা হয়েছে সেহেতু এগুলো অফিসিয়াল ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হবে। এরপরেও ফোনালাপের কণ্ঠস্বরগুলোর ফরেনসিক টেস্ট করা হয়েছে। সিআইডি কর্তৃক করা টেস্টের রিপোর্টে বলা হয়েছে এগুলো শেখ হাসিনা, ইনু, তাপস ও মাকসুদ কামালের। এগুলো এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্ট) দিয়ে বানানো নয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা ও বিবিসি এসব ফোনালাপ নিয়েও ডকুমেন্টারি তৈরী করেছে। তারা নিজস্ব এক্সপার্ট দিয়ে এ ফোনালাপগুলো পরীক্ষা করেছে। তারাও বলেছে এসব ফোনালাপ এআই জেনারেটেড নয়।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করা ও দমনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে। সেসব হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়েছে আন্দোলনকারীদের উপর। তদন্ত কর্মকর্তার দেয়া চিঠির প্রেক্ষিতে র্যাব ও পুলিশ জানিয়েছে যে, আন্দোলনের সময় ৩৬ বার ফ্লাই করেছে হেলিকপ্টারগুলো। এগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর রোডসহ বিভিন্ন স্থানের উপর দিয়ে উড্ডয়ন করেছে।
যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে চিফ প্রসিকিউটরকে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করবেন চিফ প্রসিকিউটর।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠা করা হয় এনটিএমসি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নাগরিকদের মুঠোফোনে আড়ি পাতার পাশাপাশি গোপনে ই-মেইলে নজরদারির অভিযোগ ছিলো এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এছাড়া গত দেড় দশকে বিরোধী মতাদর্শের রাজনীতিবিদদের ফোন কলের অডিও-ভিডিও রেকর্ড ধারন করে হেনস্তা করারও বিস্তর অভিযোগ ছিলো। এমনকি এসব রেকর্ড বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরবরাহ করে তা প্রচার চালাতে প্ররোচনা দিয়েছিলো এনটিএমসির তৎকালীন কর্তাব্যক্তিরা। আর এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন মে. জে (অব) জিয়াউল আহসান। যার বিরুদ্ধে গত দেড় দশকে বিস্তর গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে। জিয়াউল আহসান জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।