শিরোনামঃ
পাল্টা হামলায় ৫৮ পাক সেনা হত্যার দাবি আফগানিস্তানের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব এহসানুল হক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে লাইভ চলাকালে ফেসবুক পেজে সাইবার হামলা: চিফ প্রসিকিউটর শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু ইতালির উদ্দেশে দেশ ছাড়লেন প্রধান উপদেষ্টা একা গিয়ে কী করবো, সেফ এক্সিট নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অপরাধের সুষ্ঠু ও নির্মোহ বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: বিএনপির বিবৃতি আর কোনো সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরিকল্পনা নেই : প্রেস সচিব পরোয়ানা জারি হওয়া ১৫ সেনা কর্মকর্তা হেফাজতে: সেনাবাহিনী জুলাই সনদ স্বাক্ষরের তারিখ পেছালো
রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৫৩ অপরাহ্ন

জুলাই আগুনে যারা আলো জ্বালিয়েছিল

শাহেদ শফিক, লন্ডন
প্রকাশ: রবিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৫

কথায় আছে, যখন ইতিহাস যখন রচনা হয়, তখন কলম আর কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে বিদ্রোহের সমান শক্তিশালী অস্ত্র। ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই আন্দোলন সেই বিরল এক অধ্যায়। যেখানে কেবল রাজপথ নয়, সংবাদপত্রের পাতাও আন্দোলনের মাঠে পরিণত হয়েছিল। এই আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও ছিল একটি ঐতিহাসিক বাঁক। যা শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পতনের পথকে সুগম করেছিল। আর সেই পথে আলো জ্বালিয়েছিলেন কিছু সাহসী, নির্ভীক এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিক, যারা জাতির বিবেক হিসেবে নিজেদের আত্মমর্যাদাকে বিসর্জন দেননি। তবে এই যাত্রা ছিল না একরৈখিক। সাংবাদিকতার ভেতরেও ছিল সুস্পষ্ট বিভাজন। একদিকে ছিলেন একদল, যারা বছরের পর বছর স্বৈরাচারী সরকারের মুখপাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। এরা গৃহপালিত সাংবাদিক, যাদের কলম ছিল বিক্রীত, যারা দেশপ্রেমকে বানিয়ে ফেলেছিলেন শেখ হাসিনার স্তবগানে। তাদের নাম ইতিহাসে থাকবে কালো হরফে। অন্যদিকে, ছিলেন সাহসী সংবাদযোদ্ধারা যারা গ্যাস, গুলি আর লাঠির মাঝ দিয়ে তুলে এনেছেন মাঠের সত্য। ক্যামেরা আর কলমে তারা সৃষ্টি করেছেন প্রতিবাদের আগুন। কেউ হয়েছেন গ্রেপ্তার, কেউ নির্যাতনের শিকার, তবুও তারা ছিলেন ছাত্র-জনতার পাশে। তারা বলেছেন দেশটি কোনো স্বৈরাচারী ব্যক্তির সম্পত্তি নয়, এই দেশ জনগণের, এই দেশ গণতন্ত্রের। তাদের এই অবদান ইতিহাসে সম্মানের আসনে স্থান পাবে।

বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে যেসব সাংবাদিক স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন, তারা প্রমাণ করেছেন, স্বাধীন সাংবাদিকতা এখনো মরে যায়নি শুধু তাকে খুঁজে নিতে হয় ভিড়ের মধ্য থেকে। এই আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক ছিল, প্রযুক্তি ও নাগরিক সাংবাদিকতার অসাধারণ ব্যবহার। এই সাহসী সাংবাদিকদের কারণেই আন্দোলনের বাস্তব চিত্র দেশ-বিদেশে পৌঁছেছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের দুঃসহ বাস্তবতা উঠে এসেছিল। আন্দোলনে যারা শহীদ বা আহত হয়েছেন তাদের কাহিনি শুধুই সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে হারিয়ে যেত, যদি না কিছু সৎ সাংবাদিক সেই গল্পগুলোকে হৃদয়ের স্পন্দন দিয়ে লিখে যেতেন। জুলাই আন্দোলন প্রমাণ করেছে, সাংবাদিকতা নিছক কোনো পেশা নয়, এটা এক ধরনের দায়বদ্ধতা, এটা এক ধরনের নৈতিক সংগ্রাম। যারা এই সংগ্রামে সত্যকে বেছে নিয়েছেন, তারা ইতিহাসের চোখে সম্মানের আসনে আসীন থাকবেন। আর যারা কেবল সুবিধা নেওয়ার জন্য ‘নিরপেক্ষতা’র মুখোশ পরে স্বৈরতন্ত্রকে সেবা দিয়েছেন, তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। তবে এই কলামে আরেকটি দিকও স্পষ্টভাবে বলা দরকার গৃহপালিত সাংবাদিকদের ভূমিকা শুধুমাত্র লজ্জার নয়, এটি ছিল অপরাধ। কারণ সাংবাদিকতা কোনো নিরপেক্ষ বসে থাকা পেশা নয়; এটি একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা, যেখানে অন্যায়ের পাশে চুপ থাকা মানেই অন্যায়কে সহায়তা করা। এরা সেটা শুধু করেননি, বরং সক্রিয়ভাবে সত্যকে ঢেকে, মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে সরকারকে টিকে থাকার রসদ জুগিয়েছেন।

এই আন্দোলনে সাংবাদিকরা ছিলেন যেন বাতিঘর। যারা ধোঁয়াশায় ঢাকা পথকে আলোকিত করেছেন তাদের নৈতিক সাহস, নিষ্ঠা ও সত্যের প্রতি অনমনীয় দায়বদ্ধতা দিয়ে। তারা শুধু খবর সংগ্রহ করেননি, সত্য বুনেছেন শব্দে শব্দে। ক্যামেরার লেন্সে বন্দি করেছেন প্রতিরোধের প্রতিটি আভা। যখন গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছে রাজধানীর রাজপথ, যখন পুলিশের বুটের নিচে থেঁতলে গেছে ছাত্রের চিৎকার ঠিক তখনই সাংবাদিকরা বুক চিতিয়ে ধরেছেন মাইক্রোফোন। হয়তো কেউ কেউ বলেছেন, ‘দেখুন, সত্য এভাবেই রক্তাক্ত হয়।’ আজ নতুন বাংলাদেশ গঠনের পথে সাংবাদিকদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে, তথ্যকে মুক্ত রাখতে হয়। সত্যকে উচ্চারণ করার সাহস যদি না থাকে, তবে যে শাসনই আসুক, সেটি কখনোই টেকসই গণতন্ত্র হবে না। তাই এখন প্রয়োজন সেই মুক্তিকামী সাংবাদিকদের আরও সংগঠিত করা, তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং নতুন প্রজন্মের সংবাদকর্মীদের সামনে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা। এই অবস্থায় নতুন করে সাংবাদিক সমাজের ভেতরের এই বিভাজনকে চিহ্নিত করা জরুরি সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকরা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে ভবিষ্যতেও গণতন্ত্র রক্ষার প্রধান হাতিয়ার হবেন। অন্যদিকে যারা নিজেদের আত্মা বেঁচে দিয়েছিল, তাদের নাম ইতিহাসের কালো পাতায় লেখা থাকবে লজ্জার ছায়ায়।

জুলাই আন্দোলন ছিল রাজপথের যুদ্ধ। কিন্তু সেই যুদ্ধে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছে কিছু সংবাদপত্র, টেলিভিশন, ইউটিউব, ফেসবুক এবং মাঠের কিছু সাংবাদিকের সাহসী উচ্চারণ। তাদের বুলিই ছিল গুলি ঠেকানোর একেকটি ঢাল। তাদের ছবি ছিল প্রতিবাদের মুখচ্ছবি, আর তাদের ভিডিও ছিল গণজাগরণের প্রকৃষ্ট দলিল। ইতিহাস তাদের মনে রাখবে। আর যারা ক্ষমতার পায়ে বসে কলম চালিয়েছে, তারা হয়তো সেই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে। যেই যন্ত্রণা তাদের সারা জীবন বিদ্ধ করে যাবে। হৃদয়ে থাকবে চিরস্থায়ী কালো দাগ, একটি ঐতিহাসিক বিজয়ের অংশ হতে না পেরে। এই আন্দোলনের পরতে পরতে যেমন ছিল রাজপথের প্রতিরোধ, তেমনি ছিল সংবাদমাধ্যমের ভেতরে এক গভীর দ্বন্দ্ব যেখানে সাংবাদিকতা নিজেই বিভক্ত হয়ে পড়ে বিবেকের লড়াইয়ে। এই লড়াই ছিল সত্য ও মিথ্যার মধ্যে, দায়িত্বশীলতা ও সুবিধাবাদের মধ্যে আর নির্লজ্জ আনুগত্য ও নৈতিক সাহসের মধ্যে। কেউ কেউ ক্ষমতাকেন্দ্রিক সুবিধা আর মালিকানার চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করে বেছে নিয়েছিলেন নীরবতা কিংবা মিথ্যাচার। অন্যদিকে কিছু সাহসী সাংবাদিক দাঁড়িয়েছিলেন, সেই মিথ্যার মুখোমুখি, কলম ও ক্যামেরার ফ্রেমে তুলে ধরেছিলেন অবরুদ্ধ সত্য। এই দ্বৈততা শুধু সাংবাদিক সমাজকে নয়, গোটা জাতিকেই মনে করিয়ে দেয় বিপ্লব কেবল রাজপথে হয় না তা হয় বিবেকেও। আর এই বিবেকের লড়াইয়েই চিহ্নিত হয়, কারা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় সম্মানিত হবেন আর কারা হারিয়ে যাবেন ভয়াবহ অতল অন্ধকারে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

Shahedshafiq24@gmail.com


এ জাতীয় আরো খবর...