৬০ দশকের অবিভক্ত ছাত্রলীগের তথা সমগ্র দেশের ছাত্র ও যুব সমাজের মুকুটহীন সম্রাট, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মেধাবী ও আপোষহীন বিপ্লবী ছাত্র নেতা, যার ডাকে সমগ্র দেশের ছাত্র ও যুবসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১১ দফা, ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলা, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও স্বাধীকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং আন্দোলনের মাধ্যমে মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানকে বাধ্য করে এবং তার ক্ষমতার মসনদ করে দেয়। এই সময়ের মধ্যে উনাকে সর্বমোট ৩টি বছর কারাগারে থাকতে হয়।
যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ছাত্রলীগ হয়ে উঠে দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন, সেই সংগ্রামী ছাত্র নেতা ড.ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী’র রবিবার (৩১শে আগস্ট) ৫ম মৃত্যু বার্ষিকী।
ড.ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর সংক্ষিপ্ত জীবনী:-
১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এর বোর্ড পরীক্ষায় সমগ্র দেশের মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অধিকার করেন। ঐ বছরেই তৎকালীন আরসিডি জোট,( পাকিস্তান ইরান ও তুরস্ক) কর্তৃক আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম স্হান অধিকার করায় জোটের খরচে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশ সহ ইরান ও তুরস্ক ভ্রমণ করেন।
১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে কলেজের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৬১ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আইন কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জীবনের প্রথম কারাবরণ করেন।
১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতারা দলের কোন ঘোষনা পত্র তৈরি না করে কেবল বক্তৃতা বিবৃতি ও প্রচারের মাধ্যমে দল করেছেন। এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে থাকাকালীন ১৯৬২ সালে তিনি একটি প্রচার পত্র তৈরি করেন এই প্রচার পত্রকেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের খসড়া ঘোষনা পত্র ও কর্মসূচি নাম দিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে মুদ্রণ করে সারা দেশে বিলি করা হয়। সেটাই ছিল ছাত্রলীগের আদর্শিক ভিক্তিক প্রথম দলিল।
উনি চট্টগ্রামে ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করে তুলেন।
১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ইতিমধ্যে তিনি ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ সারাদেশে ছাত্র সমাজের প্রিয় নেতা হয়ে উঠেন।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি মেধাবী ফেরদৌস আহমদ কোরেশীকে ঘোষণা পত্র করার দায়িত্ব দিলে উনি তাহা মুসাবিদা করে জমা দিলে কমিটিতে তাহা কোন পরিবর্তন ছাড়া সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন হয় এবং ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই ঘোষনাপত্র ছিল সারা দেশের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হ্যান্ডবুক।
১৯৬৩ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ সভাপতি নির্বাচিত হন , উক্ত সময় সভাপতি কারাগারে থাকায় তিনি ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৫-৬৬ সেশনে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন ( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ছাত্রলীগের প্রথম ভিপি পদ অর্জন করেন)।
১৯৬৭- ৬৮ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
দেশের যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে ফেরদৌস কোরেশীর ছাত্র জীবনের (ষাটের দশক) পুরো সময়টা আন্দোলন, সংগ্রাম, জেল, জুলুম ও নির্যাতনের মাধ্যমে কেটেছে , আন্দোলন বন্ধ করতে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়, তাঁর পরিক্ষা স্থগিত করা হয় তবুও তিনি আপোষ করেননি এবং আন্দোলনে পিছপা হননি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ফেরদৌস আহমদ কোরেশী তাঁর দল ও ছাত্র সংগঠনের সকলকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে নিজেও যোগ দেন। তাঁর পরিবারের ১০ ভাই বোন এতে অংশ নেন।
রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধাদের উৎসাহিত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর নিয়ে উনার সম্পাদনায় কলকাতা থেকে “দেশবাংলা” নামে মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র হিসাবে প্রকাশ শুরু করেন। যাহা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প সহ বাংলাদেশর বিভিন্ন স্থানে বিলি করা হতো।
দেশ স্বাধীনের পর দেশের ক্রান্তিকালে ও দুঃসময় তিনি সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সাংবাদিকতায় বস্তূনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের সাহসী ভূমিকা রেখে গেছেন।
এরশাদের সামরিক শাসনের বিরোধিতা করায় তাঁকে দীর্ঘ ১বছর কারাগারে থাকতে হয়।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশের গনতান্ত্রিক সমাজ বিপ্লবের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক আপোষহীন সংগ্রামী নেতা, ভু-রাজনৈতিক ও কলামিস্ট। যিনি লোভ লালসা ও ভয়ের কাছে কখনো আত্মসমর্পণ না করে আজীবন লড়াই করে গেছেন শুভ, সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের পক্ষে।
ফেনীর দাগনভুঁইয়ার বাসুদেবপুর গ্রামে ১৯৪২ সালের ১৪ই জানুয়ারী তিনি জন্মগ্রহণ করেন কোরেশী। ২০২০ সালে ৩১শে আগষ্ট ঢাকাতে মৃত্যুবরণ করেন। গ্রামের বাড়িতে বাবা মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন কোরেশী।