জেলা পর্যায়ে আদর্শগত ও পেশাদার সাংবাদিক গড়ে না ওঠার পেছনে বহুমুখী ও আন্তঃসম্পর্কিত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এরমধ্যে আছে- প্রশিক্ষণহীনতা, আর্থিক অনিরাপত্তা, রাজনৈতিক প্রভাব, নৈতিক দুর্বলতা, তথ্যপ্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা ও প্রযুক্তিগত ঘাটতি। এই পর্বে এসব বাস্তবিক কিছু অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা থাকবে।
১. স্থানীয় পরিচিতি ও রাজনৈতিক সংযোগ: জেলায় সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সাংবাদিক কোন না কোন পক্ষের লোক হয়ে যায়। কারণ জাতীয় মাধ্যমে তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগই রাজনৈতিক বা স্থানীয় নেতাদের সুপারিশ প্রাধান্য পায়। যেটি মূলধারার গণমাধ্যমেও অনেকটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ব্যবসায়ী বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সংবাদ পরিবেশনের ওপর সরাসরি প্রভাব খাটান। মিডিয়ার মালিকদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় সমালোচনামূলক সংবাদ প্রকাশে ভয় বা সেন্সরশিপ তৈরি হয়, একপক্ষীয় প্রচারণা বাড়ে, যা জনমতকে বিভ্রান্ত করে, এতে পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ, গুরুতর ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া বা সত্যকে বিকৃত করা হয়।
২. নিরাপত্তাহীনতা: জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউটের ২০২২ সালে তথ্যে জেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের ৬৫% স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী/রাজনীতিবিদদের চাপে থাকেন। এছাড়া কোন সংবাদ কারো বিপক্ষে গেলেই সাংবাদিককে হুমকির শিকার ও মামলার ঝুঁকিতে থাকতে হয়। এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতাও হতাশাজনক। একজন সাংবাদিক যখন দুর্ঘটনায় পড়েন, অন ডিউটিতে হামলা মারধরের শিকার হন। যখন তার শেষ সম্বল ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, ট্রাইপড, মোবাইল ফোন ভাঙচুর/কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে, তখনও তার প্রতিষ্ঠান তাদের পাশে দাঁড়াতে সংকোচবোধ করে, নানা যুক্তিতে দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এতে সাংবাদিকের সাহস কমে, বাড়ে স্ব-সেন্সরশিপ।
৩. নিয়োগ ও সম্মানীভাতা: আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর বেশিরভাগ জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকদের নিয়োগ দেয় চুক্তিভিত্তিক ও অস্থায়ীভাবে। এক্ষেত্রে তাদের জন্য নির্ধারিত বেতন কাঠামো ও সুযোগ সুবিধাও নেই বললেই চলে, আর পদোন্নতি দূরের কথা। কিছু প্রতিষ্ঠান সম্মানীভাতা যৎসামান্য দিলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান তাও দেয় না। এতে প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার দায়বদ্ধতা তেমন থাকে না, থাকে না কোন আন্তরিকতা। ফলে বঞ্চিত সংবাদকর্মী হিসাবে তার পেশাদারিত্বের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব: জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকতা বা গণযোগাযোগ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা/প্রশিক্ষণের কোন সুযোগ নেই। ঢাকাসহ বড় শহরভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিধারীরা জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকতায় যুক্ত হতে চান না, এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। ফলে মেধা শূন্য স্বল্প শিক্ষিতরা জেলা সাংবাদিকতায় জড়িয়ে এই পেশাকে করছেন বিতর্কিত। আর জেলায় পেশাদার কোন সাংবাদিকও গড়ে ওঠে না।
৫. আর্থিক অনিশ্চয়তা: আমাদের দেশের জেলা পর্যায়ের সংবাদপত্র/মিডিয়ার রেভিন্যু মডেল অনেক দুর্বল(বিজ্ঞাপন আয় কম)। এছাড়া যারা কেন্দ্রীয় মিডিয়া বা জাতীয় মিডিয়াতে যুক্ত হন তাদের মধ্যে হাতেগোনা প্রতিষ্ঠান যে সম্মানীভাতা দেয়, তা দিয়ে জেলায় একজন সাংবাদিকের জীবনধারণ প্রায় অসম্ভব। টিআইবির ২০২৩ সালের দেয়া তথ্যে, জেলা পর্যায়ে একজন সাংবাদিকের গড় মাসিক বেতন ৮,০০০-১৫,০০০ টাকা। বাস্তবতা এমন একজন অটোরিকশা চালকের মাসিক আয় সাংবাদিকের চেয়ে বেশি। অনেক জেলা প্রতিনিধিকে মাসিক বেতন না দিয়ে দেয়া হয় সংবাদপ্রতি কিছু টাকা।
৬. প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: জেলার সাংবাদিকদের প্রায় সবাই প্রফেশনাল ইকুয়েপমেন্ট ব্যবহার করেন না বা করতে পারেন না। হাতের মোবাইল ফোন ও ফেসবুক, গুগল, বড়জোড় ইউটিউবের কিছু পরামর্শই তাদের প্রযুক্তি জ্ঞানের উৎস। বিনা পয়সার শ্রমিক হিসাবে কেউ নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এসব জ্ঞান নিতে চায় না। এছাড়া দূর্গম এলাকায় ইন্টারনেট/ডিজিটাল টুলসের অপ্রতুলতা রয়েছে।
৭. পেশাগত যোগাযোগের অভাব: নানা কারণেই জাতীয় কেন্দ্রীয় মিডিয়ার সাথে জেলার সাংবাদিকদের সম্পর্কের ব্যাপক দূরত্ব বা ঘাটতি দেখা যায়। এছাড়া সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো জেলা পর্যায়ে তেমন একটা কার্যকর নয়। জাতীয়ভাবেও এসব সংগঠনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তারা সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়নের চেয়ে রাজনীতিকেন্দ্রিক কার্যক্রমেই ব্যস্ত থাকে। ফলে প্রশিক্ষণ, মেন্টরশিপ বা ক্যারিয়ার উন্নয়নের সুযোগ কম থাকে জেলার সাংবাদিকদের।
৮. সংগঠনের ভেতরে দলাদলি ও নৈতিক দুর্বলতা: জেলার সাংবাদিক সংগঠনগুলো প্রায়শই ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থে বিভক্ত। নেতৃত্ব নির্বাচনে যোগ্যতার বদলে আনুগত্য ও ঘনিষ্ঠতা প্রাধান্য পায়। এতে দুর্বল সাংবাদিকরাও প্রেস কার্ড পেয়ে যান, যা পুরো পেশার ভাবমূর্তি নষ্ট করে। এতে ব্ল্যাকমেইলিং বা হলুদ সাংবাদিকতার দাপট বেড়ে যায়।
৯. গণমাধ্যম মালিকানার কাঠামোগত সমস্যা: সরকারি নিবন্ধন নিয়ে চালু করা হলেও অনেক গণমাধ্যম তা কেবল ‘প্রেস কার্ড’ ব্যবসার জন্য চালানো হয়। টেলিভিশন/পত্রিকা/অনলাইন পোর্টালসহ অনেক গণমাধ্যম আছে যারা জেলার সাংবাদিকদের আইডি কার্ড প্রতিবছর নবায়ণ করে থাকে অর্থের বিনিময়ে। আর মালিকরা এসব সাংবাদিকদের উপর চাপিয়ে দেন ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক এজেন্ডা। ফলে প্রকৃত সাংবাদিকতা পেছনে পড়ে যায়।
১০. তথ্যপ্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা: জেলা/উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসন বা সরকারি অফিস সাংবাদিকদের তথ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে। এতে যাচাইযোগ্য তথ্য ছাড়া প্রতিবেদনে ভুল বা গুজব যুক্ত হয়। আবার স্থানীয় ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী তথ্য লুকিয়ে জনমত নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায়।
১১. মানসিকতা ও পেশার প্রতি সম্মানহীনতা: জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকতাকে অর্ধ-বেকার পেশা হিসেবে দেখা হয়। আবার অনেকে নিজের প্রভাব দেখাতে সাংবাদিকতাকে আইডি হিসাবে ব্যবহার করেন। আছে সাংবাদিক-পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন। এছাড়া জেলার সাংবাদিক স্থানীয়দের কাছে একজন পেপারওয়ালা/সাংঘাতিক/ধান্দাবাজ হিসাবেই পরিচিত। যে কারণে অনেক সাংবাদিক হীনমণ্যতায় ভোগেন।
সমাধানের পথ: জেলা পর্যায়ের পেশাগত সাংবাদিকতা উন্নত করতে বাস্তবসম্মত ও প্রয়োগযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আর তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। তার আগে নিশ্চিত করতে হবে- মিডিয়া হাউসের মালিক কারা হবেন, মিডিয়া কি শুধু ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার হবে- নাকি জনস্বার্থে! উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
১. প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন:
• বাধ্যতামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণ: নতুন সাংবাদিকদের জন্য অন্তত ৩-৬ মাসের রিপোর্টিং, এডিটিং, ভিডিওগ্রাফি, নৈতিকতা ও তথ্য যাচাই প্রশিক্ষণ চালু করা। কেন্দ্রীয় মিডিয়া হাউসের উদ্যোগে এসব বাস্তবায়িত হতে হবে।
• নিয়মিত কর্মশালা: জেলা শহরে প্রতি ৩ মাস অন্তর পেশাগত আপডেট ও বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ যেমন- অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, ডিজিটাল সিকিউরিটি, ডাটা জার্নালিজমের আয়োজন করা।
• মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম: অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের মাধ্যমে নতুনদের হাতে-কলমে শেখার সুযোগ তৈরি করা।
• অনলাইন প্রশিক্ষণ: যাতে সময় ও দূরত্বের সীমাবদ্ধতা দূর হয়, আর এ দায়িত্ব নিতে হবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানকেই।
২. আর্থিক কাঠামো ও পেশাগত স্থায়িত্ব:
• ন্যূনতম বেতন কাঠামো: জেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের জন্য সরকার ও গণমাধ্যম মালিকদের সমঝোতায় ন্যূনতম মাসিক বেতন নিশ্চিত করা। ধান্দাবাজ সাংবাদিকতা বন্ধ করতে প্রতিটি মিডিয়া হাউসের উচিত সাংবাদিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা।
• সংবাদপ্রতি পেমেন্ট বাতিল: সংবাদ দিলে টাকা পদ্ধতি বাদ দিয়ে চুক্তিভিত্তিক বা স্থায়ী পদ তৈরি।
• স্থানীয় বিজ্ঞাপন নীতি: জেলা পর্যায়ের বিজ্ঞাপনের একটি অংশ স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রাতিষ্ঠানিক আয় হিসেবে বরাদ্দ করা।
• বীমা ও স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা: পেশাগত ঝুঁকি ও অসুস্থতার জন্য এই সুরক্ষা থাকা জরুরি।
৩. রাজনৈতিক প্রভাব ও নৈতিকতা নিয়ন্ত্রণ:
• প্রেস কার্ড প্রদানে কঠোর মানদণ্ড: অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ও কর্মপ্রমাণ ছাড়া প্রেস কার্ড না দেওয়া।
• সাংবাদিক সংগঠনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ: সাংবাদিক সংগঠন পরিচালনায় রাজনৈতিক নেতা বা প্রভাবশালীদের প্রভাব আইনগতভাবে বন্ধ করা।
• নৈতিক সনদ: সাংবাদিকতা শুরু করার আগে পেশাগত আচরণবিধি মানার লিখিত অঙ্গীকার।
৪. তথ্যপ্রাপ্তি ও আইনের প্রয়োগ:
• তথ্য অধিকার আইন কার্যকর: জেলা পর্যায়ে তথ্য কর্মকর্তাদের সাংবাদিকদের জন্য নিয়মিত ব্রিফিং দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
• আইনগত সুরক্ষা: সংবাদ প্রকাশের কারণে হয়রানি বা মামলার মুখোমুখি হলে প্রতিষ্ঠানকে আইনি সহায়তা প্রদান করা।
• প্রমাণ-নির্ভর রিপোর্টিং: সব সংবাদেই ন্যূনতম দুই পক্ষের বক্তব্য নেওয়া বাধ্যতামূলক করা।
৫. প্রযুক্তি ও আধুনিক সরঞ্জাম:
• সরঞ্জাম সহায়তা: ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি ক্রয়ে আর্থিক সহায়তা বা ভর্তুকি প্রদান।
• ডিজিটাল দক্ষতা: ভিডিও এডিটিং, সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট প্রোডাকশন, সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান।
• ইন্টারনেট অবকাঠামো উন্নয়ন: জেলার সাংবাদিকদের জন্য হাইস্পিড ইন্টারনেট অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা।
৬. নিরাপত্তা ও সামাজিক স্বীকৃতি:
• সাংবাদিক নিরাপত্তা আইন: পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আক্রমণ বা হুমকিদাতার কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। ঝূঁকিপূর্ণ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সাংবাদিক সুরক্ষা আইন ও কঠোরভাবে তার প্রয়োগ করা।
• হেল্পলাইন ও ইমার্জেন্সি নেটওয়ার্ক: ঝুঁকির মুখে পড়লে তাৎক্ষণিক সহায়তার ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনে আলাদা হেল্পলাইন চালু করে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
• জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক পুরস্কার: জেলার পেশাদার ও দায়িত্বশীল সাংবাদিক তৈরি করতে প্রতি বছর জাতীয়ভাবে/প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পুরস্কারের ব্যবস্থা করা। যা একজন সাংবাদিকের সামাজিক মর্যাদা ও পেশাদারিত্বের প্রেরণা বৃদ্ধিতে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
মুল কথা হলো- যতদিন না সাংবাদিকদের জন্য স্থায়ী আয়, প্রশিক্ষণ, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও নৈতিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাবে, ততদিন জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকতা পেশাগত মানে দাঁড়াতে পারবে না। আর তা সম্ভব হলেই- যেকোন সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের শক্তিশালী স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবে।
Disclaimer
This writing is not intended to target any individual, organization, government or non-government institution or any media outlet. Furthermore, it is not meant to offend or provoke any disorder, religious belief, political affiliation, ideology, profession, ethnicity or gender identity.
Nazrul Islam Tomal
Country Editor
Independent Television
Dhaka.