চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় কেন বার বার দুর্ঘটনা ঘটছে তার কোন উত্তর মিলছে না। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ নিজের মতো করে বলছেন নানা কারন এ দুর্ঘটনার পেছনে। চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকার দুর্ঘটনা নিয়ে ‘কলকণ্ঠ’ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছে সেসব মতামত।
গাড়ি চালক, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ওই এলাকার উঁচু-নিচু সড়কে বাঁকগুলো খুব বিপদজনক। ঈদের ছুটি ছাড়াও ভ্রমন মৌসুমে দেশের অন্যান্য জেলা থেকে আসা চালকরা অপ্রশস্ত এ অচেনা সড়কে দুর্ঘটনায় পড়ছেন। এটিই সবচেয়ে আলোচনায় উঠে আসে।
বারবার দুর্ঘটনা ঘটায় সেখানকার সড়ক সংস্কার ও প্রশস্ত করার দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।
লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকাটি চট্টগ্রাম থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে। জাঙ্গালিয়ার চুনতি অভয়ারণ্য সংলগ্ন বন বিটের অংশে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ঢালু পাহাড়ি সড়ক। এর মধ্যে কয়েকটি বিপদজনক বাঁক আছে। সারা বছরই সড়কের এ অংশে দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।
স্থানীয়দের ভাষ্য, জাঙ্গালিয়া ও আশেপাশের অংশের সড়কে সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার পর দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।
সব শেষ সদুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের ২ আরোহী নিহত হন । চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় ১৫ আগস্ট (শুক্রবার) রাত ১টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এর আগে বড় দুর্ঘটনা ঘটে রমজানের ঈদের একদিন বাদে ২ এপ্রিল বুধবার সকালে যাত্রী নিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছিল একটি মাইক্রোবাস। অন্যদিকে কক্সবাজার থেকে যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রামে যাচ্ছিল রিলাক্স পরিবহনের একটি বাস।
সকাল সোয়া ৭টার দিকে দুই বাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের ১০ আরোহীর মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনার পর রিলাক্স বাসের যাত্রী মতিন মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, সেখানে বাঁক নেওয়ার সময় বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারান। পরে ব্রেক করতে গিয়ে মাইক্রোবাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
যে স্থানে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেখান থেকে মাত্র ৩০-৩৫ গজ দূরে ঈদের দিন সকালে বাস ও মিনিবাসের সংঘর্ষে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। পরদিন কাছাকাছি এলাকায় দুটি মাইক্রোবাস সড়ক থেকে উল্টে পাশের খাদে পড়ে গেলে ১২ জন আহত হন।
একই এলাকায় বারবার দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে লোহাগাড়া থানার ওসি বলেন, “প্রথমত বলতে চাই বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছে। দ্বিতীয়ত রাস্তায় এক ধরনের লবণ পানি হচ্ছে, যার কারণে স্লিপারি হয়ে যাচ্ছে। যে মুহূর্তে ব্রেক করে, সাথে সাথে দুর্ঘটনা ঘটে।“পাশাপাশি এখানে যে রোড ইঞ্জিনিয়ারিং, যে বাঁকটা আছে, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার।”
লোহাগাড়ার স্থানীয় সাংবাদিক হামিদ কায়সার মনে করেন, চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকার উঁচু-নিচু পাহাড়ি সড়ক এবং বাঁক পর্যটকদের নিয়ে আসা অন্য জেলার চালকদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
“ঈদের ছুটি বা কক্সবাজার সমুদ্র সৌকত ভ্রমনে বাইরের জেলার চালকরা বেশি আসেন। কিন্তু তারা এই সড়কে গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত নন। অনেক চালক গতিও বেশি তোলেন। পর্যটকদের উচিত মাইক্রোবাস বা ছোট গাড়ির পরিবর্তে ঢাকা থেকে বা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রুটে চলাচলকারী বাসে ভ্রমণ করা।”
“এই অংশে রাস্তা সামান্য ঢালু এবং অনেক বাঁক আছে। এছাড়া কক্সবাজার থেকে লবণের ট্রাক ও কাদামাটি নিয়ে ডাম্প ট্রাক আসে। তাই সকালের দিকে রাস্তা লবণের পানি ও কাদায় পিচ্ছিল থাকে, এমন অভিযোগ করেন যাত্রীবাহি পরবিহনের চালক ও যাত্রীরা।
নিয়মিত এই রুটে গাড়ি চালকরা সতর্ক থাকলেও পর্যটক নিয়ে যেসব গাড়ি বাইরে থেকে আসে, সেসব গাড়ির চালক এখানে অভ্যস্ত না। এ কারনে বেশিরভাগ দুর্ঘটনায় বাইরের কোনো না কোনো গাড়ি ছিল।”
সড়কের বাঁক অপসারণের দাবি জানিয়ে চালক মো. ইব্রাহিম বলেন, বাঁকের কারণে ছোট গাড়িকে রক্ষা করতে গিয়ে অনেকসময় বড় গাড়ির চালকরা দুর্ঘটনায় পড়েন। অন্য জেলার চালকরা এখানকার রাস্তা সম্পর্কে এতকিছু জানেন না।”
ফায়ার সার্ভিসের লোহাগাড়া স্টেশনের লিডার বলেন, “দুর্ঘটনাস্থলের আশেপাশের রাস্তা আঁকাবাঁকা। এখানে গতিরোধক থাকলে হয়ত ভালো হত।”
কক্সবাজারে এমনিতেই পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। ঈদসহ সরকারি ছুটিতে পর্যটকবাহী গাড়ির সংখ্যা যে অনেক বেড়েছে, সে কথা তুলে ধরলেন আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. মুসা। তিনি বলেন, “গাড়ির চাপ থাকলেও সড়কটি প্রশস্ত হয়নি। মহাসড়ক বললেও এটা আসলে মহাসড়ক না। বেশিরভাগ অংশে সড়ক মাত্র ২ লাইন।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের জাঙ্গালিয়া, চকরিয়ার কচ্ছপিয়া এবং বানিয়াছড়া ঢালা এই তিন স্থান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানালেন স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি।
লোহাগাড়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, এখানে বারবার দুর্ঘটনার মূল কারণ এই সড়কটি সংকীর্ণ। প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি চলে। তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
“যতদিন ৬ লেইনের রাস্তা করা না হবে, দুর্ঘটনা হবে। ৬ লেইন করে অবশ্যই মাঝে ডিভাইডার দিতে হবে। এ দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও হরতাল করার হুশিঁয়ারিও দেন তিনি।
কক্সবাজার সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন জানান, লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় সূক্ষ বাঁক থাকা এবং চলাচলরত গাড়িগুলো এক লেন থেকে আরেক লেনে চলে আসার কারণে সচরাচর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া সকাল বেলা সড়কটি ভেজা থাকে। লবণ- মাছবাহী গাড়ি থেকে পানি পড়ে সড়ক পিচ্ছিল হওয়ার কারণেও নিয়মিত সড়ক দূর্ঘটনাটি ঘটছে। এই দুর্ঘটনা স্পট চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকার মহাসড়কের দুই পাশে দুর্ঘটনা রোধে রাম্বল স্ট্রীপ তৈরি করা হবে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “জাঙ্গালিয়ার ওই অংশে এবং আশেপাশে সড়ক উঁচু-নিচু এবং আঁকাবাঁকা। “মহাসড়কের ওই অংশে কয়েক কিলোমিটার সড়কের বাঁক অপসারণ করে সোজা করা যায় কিনা সে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করছি।
সবশেষ ঈদের পরদিনের দুর্ঘটনা কবলিত এলাকা জাংগালিয়ায় পরিদর্শন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক)। পরিদর্শনকালে তিনি ওই এলাকার সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান।
অন্যদিকে যানবাহন চালকদের শর্তক করতে দুর্ঘটনা প্রবন জাঙ্গালিয়া এলাকায় সড়কের দু’পাশে লাল পতাকা বসিয়েছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ।